প্রতিটি মুসলিমের জন্য হজ্জ পালন জীবনের একটি পবিত্র লক্ষ্য। তবে অনেকেই জানেন না যে হজ্জ পালন করারও ভিন্ন ভিন্ন ধরণ রয়েছে, যার প্রতিটিতে রয়েছে নির্দিষ্ট নিয়ম ও মানসিক প্রস্তুতি। হজ্জের প্রকারভেদ মুসল্লিদের জন্য উপযোগিতা ও সুবিধার ভিত্তিতে নির্ধারিত।
এই ব্লগে আমরা হজ্জের তিনটি মূল প্রকার—তামাত্তু, কিরান ও ইফরাদ—এর বিশ্লেষণ, পার্থক্য, এবং পালন পদ্ধতি নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করব।
হজ্জে তামাত্তু হলো এমন একটি পদ্ধতি যেখানে মুসাফিররা প্রথমে উমরাহ সম্পন্ন করেন এবং পরে একই হজ্জ মৌসুমে হজ্জ পালন করেন। হজ্জে কিরান হলো উমরাহ ও হজ্জ একসঙ্গে করার পদ্ধতি, যেখানে উমরাহ পালন করা শেষ হলেও ইহরাম খোলা হয় না। অন্যদিকে, হজ্জে ইফরাদ হলো শুধুমাত্র হজ্জ সম্পন্ন করার পদ্ধতি, যেখানে উমরাহ অন্তর্ভুক্ত থাকে না।
নিচে আমরা হজ্জের প্রতিটি ধরন নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করব।
হজ্জের প্রকারভেদ
হজ্জ সাধারণত তিন প্রকারে বিভক্ত:
- হজ্জে তামাত্তু
- হজ্জে কিরান
- হজ্জে ইফরাদ
১. হজ্জে তামাত্তু
হজ্জে তামাত্তু হলো সেই প্রকারের হজ্জ, যেখানে মুসাফিরগণ প্রথমে উমরাহ পালন করেন এবং তারপর একই হজ্জ মৌসুমে হজ্জ পালন করেন। এটি সবচেয়ে সহজ ও জনপ্রিয় পদ্ধতি, বিশেষ করে তাদের জন্য যারা দূরবর্তী স্থান থেকে হজ্জের উদ্দেশ্যে মক্কা শরীফে আসেন।
তামাত্তু শব্দের অর্থ হলো ‘উপভোগ করা’। এই পদ্ধতিতে একজন মুসাফির হজ্জ ও উমরাহ উভয়টি একসাথে পালন করার সুবিধা উপভোগ করেন।
হজ্জে তামাত্তু পালনের নিয়মাবলী
১. ইহরাম বাঁধা (উমরাহের জন্য): মীকাত নামক নির্ধারিত স্থান থেকে ইহরাম বাঁধতে হয়। ইহরাম বাঁধার সময় উমরাহ পালনের নিয়ত করতে হবে এবং তালবিয়া পাঠ করতে হবে।
২. উমরাহ পালন করা: মক্কায় পৌঁছে উমরাহর কার্যক্রম সম্পন্ন করতে হয়। এর মধ্যে রয়েছে –
- কাবা শরীফ তাওয়াফ করা (সাত বার ঘোরা)
- সাফা ও মারওয়া পাহাড়ের মধ্যবর্তী সাঈ করা (সাত বার যাতায়াত)
- মাথার চুল ছাঁটা বা মুণ্ডন করা
৩. ইহরাম খোলা: উমরাহ সম্পন্ন করার পর ইহরাম খোলা যায় এবং স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসা যায়। এই পর্যায়ে ইহরামের বিধিনিষেধগুলো আর প্রযোজ্য থাকে না।
৪. ইহরাম বাঁধা (হজ্জের জন্য): হজ্জের নির্ধারিত দিনগুলোতে, সাধারণত ৮ জিলহজ্ব তারিখে, পুনরায় ইহরাম বাঁধতে হয় এবং এবার হজ্জের নিয়ত করতে হয়।
৫. হজ্জের কার্যক্রম সম্পন্ন করা: হজ্জের সময় মিনা, আরাফাত, মুযদালিফাহ এবং মক্কায় হজ্জের আনুষ্ঠানিক কার্যক্রম সম্পন্ন করতে হয়। এর মধ্যে রয়েছে –
- আরাফাত ময়দানে অবস্থান করা (৯ জিলহজ্ব)
- মুযদালিফাহতে রাত যাপন করা
- কাবা শরীফে তাওয়াফ ইফাদা করা
- মিনায় কংকর নিক্ষেপ করা ও কোরবানি করা
- মাথার চুল ছাঁটা বা মুণ্ডন করা
হজ্জে তামাত্তুর তাৎপর্য
হজ্জে তামাত্তু মুসাফিরদের জন্য একটি বিশেষ সুযোগ তৈরি করে, যাতে তারা উমরাহ এবং হজ্জ দুটোই আলাদাভাবে পালন করতে পারেন। এটি আল্লাহর ইবাদতের ক্ষেত্রে এক অনন্য মর্যাদা দেয়। উমরাহ শেষ করার পর ইহরাম খোলার সুযোগ থাকায় এই পদ্ধতি তুলনামূলকভাবে সহজ এবং সুবিধাজনক। বিশেষ করে যাদের জন্য ইহরামের কঠোর নিয়ম মানা কষ্টকর, তাদের জন্য এটি বেশ উপকারী।
আরও ভালো দিক হলো, এই পদ্ধতিতে মুসাফিরা ইহরাম থেকে বের হয়ে সাধারণ জীবনযাপন করতে পারেন এবং হজ্জের দিনগুলোতে আবার ইহরাম বেঁধে হজ্জের মূল কাজ শুরু করতে পারেন। এটি ইবাদতের একটি বিশেষ ব্যবস্থা, যা মুসলিমদের জন্য বেশি সওয়াবের কারণ হয়ে থাকে।
২. হজ্জে কিরান
হজ্জে কিরান হলো সেই প্রকারের হজ্জ যেখানে মুসাফিরগণ একই ইহরামে উমরাহ ও হজ্জ একসাথে সম্পন্ন করেন। এই পদ্ধতিটি অপেক্ষাকৃত কঠিন ও ধৈর্যশীলতার পরীক্ষা হিসাবে বিবেচিত হয়। কিরান শব্দের অর্থ হচ্ছে ‘একত্রিত করা’ বা ‘একসঙ্গে সম্পন্ন করা’। এই পদ্ধতিতে একজন হজ্জযাত্রী উমরাহ এবং হজ্জ একই ইহরামে পালন করেন এবং ইহরাম খোলা নিষিদ্ধ থাকে যতক্ষণ না হজ্জের কার্যক্রম সম্পূর্ণ হয়।
হজ্জে কিরান পালনের নিয়মাবলী
১. ইহরাম বাঁধা (উমরাহ ও হজ্জের জন্য): মীকাত থেকে ইহরাম বাঁধতে হয় এবং এই সময়ে উমরাহ ও হজ্জের নিয়ত একসাথে করতে হবে। তালবিয়া পাঠ করতে হবে এবং এই ইহরাম অবস্থাই সম্পূর্ণ কার্যক্রম সম্পন্ন করতে হবে।
২. উমরাহ পালন করা: মক্কায় পৌঁছে উমরাহর কার্যক্রম সম্পন্ন করতে হয়। এর মধ্যে রয়েছে –
- কাবা শরীফ তাওয়াফ করা (সাত বার ঘোরা)
- সাফা ও মারওয়া পাহাড়ের মধ্যবর্তী সাঈ করা (সাত বার যাতায়াত)
৩. ইহরাম খোলা নিষিদ্ধ: উমরাহ শেষ করার পরও ইহরাম খোলা যায় না। মুসাফিরকে ইহরাম অবস্থাতেই থাকতে হয় এবং এই সময়ে ইহরামের সমস্ত বিধিনিষেধ মেনে চলতে হয়।
৪. হজ্জের কার্যক্রম সম্পন্ন করা: হজ্জের নির্ধারিত দিনগুলোতে মিনায় গমন করতে হয় এবং সেখান থেকে আরাফাত, মুযদালিফাহ এবং মক্কায় হজ্জের আনুষ্ঠানিক কার্যক্রম সম্পন্ন করতে হয়।
- আরাফাত ময়দানে অবস্থান করা (৯ জিলহজ্ব)
- মুযদালিফাহতে রাত যাপন করা
- কাবা শরীফে তাওয়াফ ইফাদা করা
- মিনায় কংকর নিক্ষেপ করা ও কোরবানি করা
- মাথার চুল ছাঁটা বা মুণ্ডন করা
৫. কুরবানী করা: হজ্জে কিরান পদ্ধতিতে কুরবানী করা বাধ্যতামূলক। এটি হজ্জের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অংশ হিসেবে গণ্য করা হয়।
হজ্জে কিরানের তাৎপর্য
হজ্জে কিরান পদ্ধতিতে একজন মুসাফির আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য দুইটি ইবাদত একই ইহরামে পালন করেন। এটি ধৈর্য ও ত্যাগের প্রতীক হিসেবে বিবেচিত হয়। একটানা ইহরাম অবস্থায় থাকা এবং উমরাহ ও হজ্জ উভয় কার্যক্রম সম্পন্ন করা মুসাফিরের ইবাদতকে অধিক সওয়াবের অধিকারী করে।
এই পদ্ধতিতে মুসাফিরগণ ইহরামের কঠিন বিধিনিষেধ মেনে চলার মাধ্যমে তাদের বিশ্বাস ও আনুগত্যকে আল্লাহর সামনে উপস্থাপন করেন। এটি তাদের ধৈর্যশীলতা এবং আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের প্রচেষ্টাকে প্রকাশ করে।
৩. হজ্জে ইফরাদ
হজ্জে ইফরাদ হলো সেই প্রকারের হজ্জ যেখানে শুধুমাত্র হজ্জ পালন করা হয়, উমরাহ পালন করা হয় না। এটি সাধারণত মক্কার অধিবাসীদের জন্য প্রযোজ্য এবং অনেক সহজ ও সরল পদ্ধতি হিসেবে বিবেচিত হয়। ইফরাদ শব্দের অর্থ হচ্ছে ‘একক’ বা ‘অলাদা করা’। এই পদ্ধতিতে হজ্জ পালনকারী ব্যক্তি শুধুমাত্র হজ্জের কার্যক্রম সম্পন্ন করেন এবং উমরাহর সাথে তা মিলিত হয় না।
হজ্জে ইফরাদ পালনের নিয়মাবলী
১. ইহরাম বাঁধা (শুধুমাত্র হজ্জের জন্য): মীকাত নামক নির্ধারিত স্থান থেকে ইহরাম বাঁধতে হয়। এই সময়ে কেবল হজ্জের নিয়ত করতে হয় এবং তালবিয়া পাঠ করতে হয়। যেহেতু এই পদ্ধতিতে উমরাহর নিয়ত নেই, তাই উমরাহর কার্যক্রম সম্পন্ন করার প্রয়োজন হয় না।
২. হজ্জের কার্যক্রম সম্পন্ন করা: হজ্জের দিনগুলোতে মিনা, আরাফাত, মুযদালিফাহ এবং মক্কায় হজ্জের সকল আনুষ্ঠানিক কার্যক্রম সম্পন্ন করতে হয়। এর মধ্যে অন্তর্ভুক্ত:
- মিনায় অবস্থান করা (৮ জিলহজ্ব)
- আরাফাত ময়দানে অবস্থান করা (৯ জিলহজ্ব)
- মুযদালিফাহতে রাত যাপন করা
- কাবা শরীফে তাওয়াফ ইফাদা করা
- মিনায় কংকর নিক্ষেপ করা
- মাথার চুল ছাঁটা বা মুণ্ডন করা
৩. কুরবানী দেওয়া প্রয়োজন নেই: হজ্জে ইফরাদ পদ্ধতিতে কুরবানী দেওয়া বাধ্যতামূলক নয়। তবে, ইচ্ছা করলে কুরবানী করা যেতে পারে। এটি তামাত্তু ও কিরান হজ্জের তুলনায় অধিক সহজ এবং নির্দিষ্ট বিধিনিষেধ কম।
হজ্জে ইফরাদের তাৎপর্য
হজ্জে ইফরাদ এমন একটি পদ্ধতি, যা আল্লাহর ইবাদতের ক্ষেত্রে সরলতা ও সহজতার প্রতীক। এটি সাধারণত মক্কার বাসিন্দারা পালন করেন, কারণ তাদের জন্য উমরাহ পালন করা বাধ্যতামূলক নয়। যেহেতু মক্কার বাসিন্দারা সারা বছর উমরাহ করতে পারেন, তাই তাদের জন্য শুধু হজ্জের নিয়ত করাই যথেষ্ট।
এই পদ্ধতিতে হজ্জ পালনকারী ব্যক্তি শুধুমাত্র হজ্জের কাজে মনোযোগ দিতে পারেন। এটি তাদের জন্যও সহজ, যারা শারীরিকভাবে দুর্বল বা বয়স্ক এবং যাদের পক্ষে একই মৌসুমে উমরাহ ও হজ্জ একসাথে করা কঠিন।
হজ্জে ইফরাদ পদ্ধতিতে একজন মুসাফিরের ইবাদত সহজ ও সরল হয়। তাদের উপর ইহরামের কঠোর নিয়ম দীর্ঘদিন ধরে মানতে হয় না। এছাড়া, কুরবানীর বাধ্যবাধকতা না থাকায় এটি তুলনামূলকভাবে সহজ এবং কম ব্যয়বহুল।
কোন প্রকার হজ্জ আপনার জন্য উপযুক্ত?
হজ্জের প্রকার নির্বাচন করার ক্ষেত্রে মুসাফিরের নিজস্ব অবস্থা, ইচ্ছা ও সামর্থ্যের উপর নির্ভর করে। হজ্জের অনেক আয়াত ও হাদিস আছে। কুরআনে আল্লাহ বলেছেন:
“তোমরা আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য হজ্জ ও উমরাহ সম্পন্ন করো।” (সূরা আল-বাকারা, ২:১৯৬)
হজ্জের তিনটি প্রকারের মধ্যে আপনার জন্য কোনটি সবচেয়ে উপযুক্ত তা নির্ধারণ করা গুরুত্বপূর্ণ।
১. হজ্জে তামাত্তু: যদি আপনি উমরাহ ও হজ্জ উভয়টি একই মৌসুমে সম্পন্ন করতে চান এবং ইহরাম থেকে মুক্ত থাকার সুযোগ চান, তবে হজ্জে তামাত্তু আপনার জন্য সহজতর। এটি দূরবর্তী স্থান থেকে আগত মুসাফিরদের জন্য অধিক উপযোগী। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন: “যে ব্যক্তি তামাত্তু হজ্জ করবে, সে যেন কুরবানী করে। যদি তা সম্ভব না হয়, তবে তিন দিন হজ্জের সময়ে এবং সাত দিন ফিরে আসার পর রোযা রাখবে।” (সহীহ মুসলিম)
২. হজ্জে কিরান: যদি আপনি অধিক সওয়াবের ইচ্ছা করেন এবং ইহরাম অবস্থায় দীর্ঘ সময় কাটানোর ধৈর্য ও সামর্থ্য থাকে, তবে হজ্জে কিরান আপনার জন্য উপযুক্ত। এই পদ্ধতিতে উমরাহ ও হজ্জ উভয়টি একই ইহরামে পালন করা হয়।
৩. হজ্জে ইফরাদ: যদি আপনি মক্কার অধিবাসী হন বা শুধুমাত্র হজ্জ সম্পন্ন করতে চান, তাহলে হজ্জে ইফরাদ আপনার জন্য সবচেয়ে উপযুক্ত পদ্ধতি। এতে উমরাহর বাধ্যবাধকতা নেই এবং কুরবানীও বাধ্যতামূলক নয়।
সঠিক নিয়মে ও আন্তরিকভাবে হজ্জ পালন করাই প্রকৃত সওয়াব লাভের মূল চাবিকাঠি। হজ্জের উদ্দেশ্য আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন, তাই সবার জন্য তাদের সামর্থ্য ও অবস্থার উপর ভিত্তি করে সঠিক পদ্ধতি নির্বাচন করা উচিত।
উপসংহার
হজ্জের প্রকারভেদ এবং তাদের নিয়ম সম্পর্কে সঠিক জ্ঞান থাকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। প্রত্যেক মুসাফিরের উচিত নিজের সক্ষমতা ও পরিস্থিতি অনুযায়ী সঠিক পদ্ধতি বেছে নেওয়া এবং হজ্জের গাইডলাইন অনুসারে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য মনোযোগ সহকারে তা পালন করা।
হজ্জের প্রতিটি পদ্ধতিতে আল্লাহর ইবাদতের এক বিশেষ সৌন্দর্য বিদ্যমান। এই ইবাদত মুসলিমদের একতাবদ্ধ করে এবং তাদের আল্লাহর প্রতি গভীর বিশ্বাসকে প্রমাণ করে। তাই হজ্জ পালনের সময় খালেস নিয়ত ও আল্লাহর প্রতি পূর্ণ আনুগত্য থাকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।