ওমরা ইসলামের একটি বিশেষ ইবাদত, যা হজ্জের মতো পবিত্র নগরী মক্কায় সম্পাদন করা হয়। এটি একটি সুন্নাত ইবাদত, যা মুসলমানরা আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য পালন করে। হজ্জের তুলনায় ওমরা সহজ এবং কম সময়সাপেক্ষ, তবে এর গুরুত্ব অপরিসীম। ওমরা বছরের যেকোনো সময় করা যায়, তবে রমজান মাসে ওমরা পালনের বিশেষ ফজিলত রয়েছে।
ওমরার ফরজ সম্পর্কে জানা প্রতিটি মুসলমানের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ওমরার ফরজ কাজ ছাড়া ওমরা শুদ্ধ হয় না।
ওমরার ফরজ কয়টি?
ওমরার ফরজ মোট দুইটি। এগুলো হলো:
১. ইহরাম
২. তাওয়াফ
এই দুইটি কাজ ওমরার জন্য আবশ্যক। যদি কেউ ইচ্ছাকৃতভাবে বা ভুলে এই দুইটি ফরজ কাজ ছেড়ে দেয়, তাহলে তার ওমরা শুদ্ধ হবে না। এবার আমরা এই দুইটি ফরজ সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করব।
১. ইহরাম
ইহরাম হলো ওমরা শুরু করার নিয়ত করা এবং বিশেষ পোশাক পরিধান করা। ইহরাম শব্দের অর্থ হলো “নিষিদ্ধকরণ”। ইহরাম বাঁধার মাধ্যমে একজন মুসলমান কিছু জিনিস থেকে নিজেকে নিষিদ্ধ করে নেয় এবং পবিত্র ইবাদতের জন্য প্রস্তুত হয়।
ইহরামের পোশাক:
- পুরুষদের জন্য ইহরামের পোশাক হলো দুটি সাদা কাপড়। একটি কাপড় শরীরের নিচের অংশ ঢেকে রাখে, এবং অন্যটি উপরের অংশ ঢেকে রাখে।
- মহিলাদের জন্য সাধারণ পোশাকই ইহরাম হিসেবে গণ্য হয়, তবে তাদের মুখ এবং হাত ছাড়া শরীরের অন্যান্য অংশ ঢেকে রাখতে হয়।
ইহরাম বাঁধার পদ্ধতি:
১. প্রথমে গোসল করা বা অজু করা।
২. পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন হয়ে ইহরামের পোশাক পরিধান করা।
৩. ওমরার নিয়ত করা। নিয়ত হলো:
اَللّٰهُمَّ إِنِّيْ أُرِيْدُ الْعُمْرَةَ فَيَسِّرْهَا لِيْ وَتَقَبَّلْهَا مِنِّيْ
উচ্চারণ:
“আল্লাহুম্মা ইন্নি উরীদুল উমরাতা, ফাইয়াস্সিরহা লি ওয়াতাকাব্বালহা মিন্নি।”
অর্থ:
“হে আল্লাহ! আমি ওমরার নিয়ত করলাম, আপনি এটিকে আমার জন্য সহজ করে দিন এবং আমার কাছ থেকে গ্রহণ করুন।”
৪. তালবিয়া পাঠ করা। তালবিয়া হলো:
اللَّهُمَّ لَبَّيْكَ اللَّهُمَّ لَبَّيْكَ، لَبَّيْكَ لَا شَرِيكَ لَكَ لَبَّيْكَ، إِنَّ الْحَمْدَ وَالنِّعْمَةَ لَكَ وَالْمُلْكَ، لَا شَرِيكَ لَكَ
উচ্চারণ:
“লাব্বাইকা আল্লাহুম্মা লাব্বাইক, লাব্বাইকা লা শারীকালাকা লাব্বাইক, ইন্নাল হামদা ওয়ান্নি‘মাতা লাকা ওয়ালমুল্ক, লা শারীকালাক।”
অর্থ:
“হে আল্লাহ! আমি হাজির, আমি হাজির। আপনার কোনো শরিক নেই, আমি হাজির। নিশ্চয়ই সকল প্রশংসা, নিয়ামত এবং রাজত্ব আপনারই। আপনার কোনো শরিক নেই।”
ইহরামের সময় নিষিদ্ধ কাজ:
ইহরাম বাঁধার পর কিছু কাজ নিষিদ্ধ হয়ে যায়। এগুলোর মধ্যে রয়েছে:
- চুল বা নখ কাটা
- সুগন্ধি ব্যবহার করা
- শিকার করা
- বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হওয়া
- যৌন সম্পর্ক স্থাপন করা
২. তাওয়াফের পদ্ধতি
তাওয়াফ হলো কাবা শরিফের চারদিকে সাত চক্কর দেওয়া। এটি ওমরার একটি ফরজ আমল এবং হজ্জেরও গুরুত্বপূর্ণ অংশ। তাওয়াফ শুরু করতে হয় হাজরে আসওয়াদ (কালো পাথর) থেকে এবং ডান দিকে ঘুরে সাত চক্কর সম্পন্ন করতে হয়।
তাওয়াফের ধাপসমূহ:
১. প্রথমে হাজরে আসওয়াদের কাছে গিয়ে তাকবির (আল্লাহু আকবার) বলা এবং হাত উঠিয়ে ইশারা করা। যদি সম্ভব হয়, তবে হাজরে আসওয়াদে চুমু দেওয়া। চুমু দেওয়া সম্ভব না হলে শুধু ইশারা করাই যথেষ্ট।
২. ডান দিকে ঘুরে কাবা শরিফের চারদিকে সাত চক্কর সম্পন্ন করা। প্রতিটি চক্কর শুরু হয় হাজরে আসওয়াদ থেকে এবং শেষ হয় হাজরে আসওয়াদে ফিরে এসে।
৩. প্রতিটি চক্করের সময় হাজরে আসওয়াদের কাছে এসে তাকবির বলা এবং ইশারা করা। এটি প্রতিটি চক্করের শুরু এবং শেষের অংশ।
৪. সাত চক্কর শেষে মাকামে ইবরাহিমের কাছে দুই রাকাত নামাজ পড়া। এই নামাজ পড়া ওয়াজিব। যদি মাকামে ইবরাহিমের কাছে জায়গা না পাওয়া যায়, তাহলে মসজিদের যেকোনো জায়গায় এই নামাজ পড়া যেতে পারে।
তাওয়াফের সময় সুন্নাত আমল:
- পুরুষদের জন্য প্রথম তিন চক্করে রমল (দ্রুত হাঁটা) করা সুন্নত।
- তাওয়াফের সময় জিকির, দোয়া এবং কুরআন তিলাওয়াত করা উত্তম।
ওমরার ফরজের গুরুত্ব
ওমরার ফরজ দুইটি (ইহরাম এবং তাওয়াফ) সম্পাদন করা ওমরা শুদ্ধ হওয়ার জন্য অপরিহার্য। যদি কেউ ইচ্ছাকৃতভাবে বা ভুলে এই দুইটি ফরজ কাজ ছেড়ে দেয়, তাহলে তার ওমরা শুদ্ধ হবে না। তাই প্রতিটি মুসলমানের উচিত ওমরার ফরজ সম্পর্কে সঠিক জ্ঞান অর্জন করা এবং তা সঠিকভাবে পালন করা।
ওমরা ইসলামের একটি গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত, যা আত্মশুদ্ধি, ধৈর্য ও আল্লাহর নৈকট্য লাভের অন্যতম মাধ্যম। ইহরামের মাধ্যমে একজন ব্যক্তি নিজের পোশাক ও অবস্থান পরিবর্তনের মাধ্যমে নিজেকে আল্লাহর ইবাদতের জন্য প্রস্তুত করে। এটি মানুষকে দুনিয়াবি ভোগ-বিলাস থেকে দূরে রেখে একত্ববাদে বিশ্বাসী হতে সাহায্য করে।
অন্যদিকে, তাওয়াফ করা হলো কাবা শরীফকে কেন্দ্র করে সাতবার প্রদক্ষিণ করা, যা আল্লাহর প্রতি ভালবাসা ও আনুগত্য প্রকাশের অন্যতম প্রতীক। এটি মুসলমানদের ঐক্য, সংহতি ও ভ্রাতৃত্ববোধকে আরও দৃঢ় করে।
অতএব, ওমরা সম্পন্ন করতে হলে এই ফরজসমূহ সম্পর্কে সুস্পষ্ট জ্ঞান থাকা অপরিহার্য। একজন মুসলিমের উচিত ওমরার নিয়ম-কানুন ভালোভাবে জানা এবং তা যথাযথভাবে অনুসরণ করা, যাতে তার ইবাদত পরিপূর্ণ ও গ্রহণযোগ্য হয়।
ওমরার ফরজ ছাড়াও অন্যান্য আমল
যদিও ওমরার ফরজ মাত্র দুটি, তবে এর পাশাপাশি কিছু সুন্নাত এবং মুস্তাহাব আমল রয়েছে, যা ওমরাকে পূর্ণতা দেয়। সুন্নাত ও ওয়াজিব আমলগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো:
- সাঈ করা:
সাফা এবং মারওয়া পাহাড়ের মধ্যে সাতবার দৌড়ানো, যা হযরত হাজেরা (আ.)-এর ত্যাগের স্মরণে করা হয়। এটি ওমরার ওয়াজিব আমল।
- মাথা মুণ্ডন বা চুল ছোট করা:
ওমরার সমাপ্তির জন্য পুরুষদের চুল সম্পূর্ণ মুন্ডন করা উত্তম, তবে ছোট করলেও ওমরা শুদ্ধ হবে। মহিলাদের জন্য চুলের সামান্য অংশ কাটা সুন্নাত।
- নিয়মিত জিকির ও দোয়া:
ওমরা পালনকালে আল্লাহর জিকির, কুরআন তিলাওয়াত এবং মসজিদুল হারামে নামাজ আদায় করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
- তাওয়াফের সময় দোয়া ও ইবাদত:
ওমরার সময় বিভিন্ন দোয়া ও ইবাদত করা সুন্নাত। বিশেষ করে হজরে আসওয়াদের কাছে গেলে তাকবির বলা উত্তম।
- সামাজিক আচরণ:
অন্য হাজিদের প্রতি সদয় হওয়া, ধৈর্য ধারণ করা এবং ঝগড়া-বিবাদ এড়িয়ে চলা ওমরার আদবের অংশ।
যদিও এই আমলগুলো ফরজ নয়, তবে এগুলো ওমরার সৌন্দর্য বৃদ্ধি করে এবং অধিক সওয়াবের কারণ হয়। তাই একজন মুমিনের উচিত ফরজের পাশাপাশি সুন্নাত ও মুস্তাহাব আমলগুলোও যথাযথভাবে পালন করা।
উপসংহার
ওমরার ফরজ মাত্র দুইটি: ইহরাম এবং তাওয়াফ। এই দুইটি কাজ সঠিকভাবে সম্পাদন করলে ওমরা শুদ্ধ হয়। ইহরাম হলো ওমরা শুরু করার নিয়ত করা এবং বিশেষ পোশাক পরিধান করা, যা ওমরার প্রথম ফরজ। তাওয়াফ হলো কাবা শরিফের চারদিকে সাত চক্কর দেওয়া, যা ওমরার দ্বিতীয় ফরজ। এই দুইটি ফরজ ছাড়া ওমরা শুদ্ধ হয় না।
ওমরা পালনের মাধ্যমে মুসলমানরা আত্মশুদ্ধি লাভ করে এবং আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করে। এটি একটি আধ্যাত্মিক অভিজ্ঞতা, যা মুসলমানদের ঈমান ও তাকওয়া বৃদ্ধি করে। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, “এক ওমরা থেকে আরেক ওমরা মধ্যবর্তী সময়ের গুনাহের কাফফারা হয়ে যায়।” (সহীহ বুখারী)
তাই প্রতিটি মুসলমানের উচিত ওমরার ফরজ সম্পর্কে সঠিক জ্ঞান অর্জন করা এবং তা সঠিকভাবে পালন করা। ওমরা পালনকারীকে অবশ্যই ইহরাম ও তাওয়াফের নিয়ম-কানুন মেনে চলতে হবে এবং আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য একনিষ্ঠভাবে এই ইবাদত সম্পাদন করতে হবে।